প্রকল্প গ্রহণের ১৬ বছর পরেও শুরু হয়নি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ঘুমধুম রেললাইনের মূল কাজ। এরমধ্যে প্রকল্পের সময় আরো চার বছর ও ব্যয় সাত গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এদিকে এই প্রকল্পে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক অর্থায়ন করতে সম্মত হলেও এখনও কোন চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। তাই অর্থায়ন জটিলতা এখনও আছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। গত ৪ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিএসসি) সভায় প্রকল্পটির চূড়ান্ত ব্যয় অনুমোদিত হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। বাকি টাকা দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এদিকে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ব্যয় আরো বাড়তে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বছর টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হবে পুরো প্রকল্পের কাজ। যদিও ২০০০ সালে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১৮৫২.৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৬ বছরে প্রকল্প ব্যয় সাত গুণেরও বেশি বেড়েছে। সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিডি) আগামী মাসে জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনের জন্য তোলা হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে শুরুতে মিটার গেজ লাইন নির্মাণের কথা থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বর্তমানে ডুয়েলগেজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ব্যয় বেড়েছে সবকটি খাতে। এছাড়া ভবিষ্যতে জমি অধিগ্রহণের জটিলতা থেকে বাঁচতে সিঙ্গেল লাইন এর পরিবর্তে ডাবল লেইনের জন্য জমি কিনে রাখা হবে। প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এগুলোকে প্রধান কারণ বলছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার গুনধুম রেল লাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান আজাদীকে জানান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। শীঘ্রই জমি অধিগ্রহণ শুরু হবে। তবে এই প্রক্রিয়া শেষ হতে দেড় বছর সময় লাগতে পারে। অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুলাই আগস্ট পর্যন্ত সময় লাগবে।
তিনি দাবি করেন, জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল। এ কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। এছাড়া বারবার নকশা পরিবর্তন ও এডিবির শর্তগুলো অনুসরণ করার কারণে প্রকল্পের পরিকল্পনায় বেশি সময় নিচ্ছে। ব্যয় বাড়ার কারণ সম্পর্ক তিনি জানান, ২০০০ সালে প্রকল্পের যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল সেই সময়ের তুলনায় নির্মাণ সামগ্রীর দাম এখন অনেক বেশি। জমির দামও কয়েক গুণ বেড়েছে। শুরুতে শুধু মিটারগেজ লাইন নির্মাণ করার কথা ছিল। কিন্তু তা এখন ডুয়েলগেজ লাইনে পরিবর্তন করা হবে। তাছাড়া এ পথে আগে সিঙ্গেল লাইনের কথা ছিল এখন এর পাশে ডাবল লাইন নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ রাখার বিষয়টি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে আরেকটি লাইন নির্মাণে কোনো ঝামেলা পোহাতে না হয়।
প্রকল্প ব্যয় সাত গুণের চেয়ে বেশি বেড়েছে কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিদ্যমান প্রকল্পের সবকটি কমপোনেন্টের ব্যয়ই আগের চেয়ে বেড়েছে। জমি অধিগ্রহণ, লাইন নির্মাণ, পরামর্শক ব্যয়, প্রাইজ কন্টিনজেন্সি, সব খাতের ব্যয়ই অনেক বেশি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ করেই নতুন এ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পটি যথাসময়ে শেষ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, মূলত অর্থায়ন জটিলতায় প্রকল্পটির কাজ এগোয়নি। এডিবির এ খাতে অর্থায়নের কথা থাকলেও নানা দেন দরবার করে কোনো অর্থসহায়তা পাওয়া যায়নি। একসময় চীন এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তারা আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। নতুন প্রস্তাবনা অনুসারে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থ সহায়তায় সম্মত হয়েছে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম সীমান্ত পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০০ সালে। সে সময় প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলেও বিএনপি-জামাত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই এ লাইন নির্মাণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ২০১১ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল প্রকল্পটি ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময় পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০ কোটি টাকা খরচ হয়। পরে ব্যয় না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু তাতেও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। গত বছর জুন পর্যন্ত এতে কাজ হয়েছে মাত্র ৩১২ কোটি টাকার।
নানা জটিলতায় বারবার হোঁচট খাওয়া এ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সমাবেশে যথা সময়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ঘুমধুম রেললাইনের কাজ শুরু করা হবে বলে জানান।
চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ ভৌগোলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত ৯৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবনের ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। লাইনটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ১২৭ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার।
অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, এই রেললাইনটিতে মোট নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের ট্রেন গুলো মাঝের কোন স্টেশন ধরবে না। তবে স্থানীয়দের যাতায়াত ও মামামাল আনা নেয়ার জন্য লোকাল ট্রেন সার্ভিস থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো শেষ না করা দেশের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এতে করে মূল প্রকল্পের কয়েকগুণ টাকা সরকারকে খরচ করতে হচ্ছে। একদিকে প্রকল্পের উপযোগিতা হ্রাস পায়। অপরদিকে অধিক সময় লাগায় জনগণের ভোগান্তিও বাড়ে। আবার বাড়তি অর্থায়নে সরকারকেও চাপে পড়তে হয়। অথচ, সময়মতো তা শেষ করা গেলে ওই অর্থে অন্য কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়।
পাঠকের মতামত: